দিল্লীর অধীনে বাংলার সুলতানি শাসন

বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা

  • বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন শশাঙ্ক যিনি ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
  • ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর প্রায় দেড়শো বছর বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। এই সময় কালকে "মাৎস্যন্যায় যুগ" বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
  • এই অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে বাংলায় পাল বংশ এবং পরবর্তীকালে সেন বংশ রাজত্ব করে।
  • ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে তুর্কী বীর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি

  • ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জীবিকার অন্বেষণে গজনীতে এসে শিহাবউদ্দিন ঘোরীর সৈন্য বিভাগে চাকরি প্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। খাটো, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার জন্য নিশ্চয়ই বখতিয়ার সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হন। এরূপ শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুর্কীদের নিকট অমঙ্গল বলে বিবেচিত হতো।
  • গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লী-তে সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবেকেরী দরবারে উপস্থিত হন। এবারও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন।
  • এরপর তিনি বদাউনে যান। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন তাকে মাসিক বেতনে সৈন্য বিভাগে নিযুক্ত করেন।
  • উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এ ধরনের সামান্য বেতনভোগী সৈনিকের পদে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যা যান। সেখানকার শাসনকর্তা হুসামউদ্দীনের অধীনে তিনি পর্যবেনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
  • বখতিয়ারের সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় সন্তুষ্ট হয়ে হুসামউদ্দীন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভাগবত ও ভিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গীর দান করেন।
  • বখতিয়ার অল্পসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে শুরু করেন।
  • এ সময়ে তার বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলমান তার সৈন্যদলে যোগদান করে। ফলে বখতিয়ারের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
  • তিনি বিহারের ওদন্ত বৌদ্ধবিহার আক্রমণ করেন। এখানে তাঁর সৈন্যরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করে। কালক্রমে এই বিহারটি বিহার শরিফ নামে পরিচিতি লাভ করে।
  • বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার অনেক ধনরত্নসহ দিল্লীর সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
  • কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন এবং বিহারের ওই অঞ্চল শাসনের অনুমতি দেন।
  • অধিক সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি পরের বছর নবদ্বীপ বা নদিয়া আক্রমণ করেন।
  • লক্ষণ সেন প্রাসাদ ত্যাগ করে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন এবং নদিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বিনা বাধায় কুতুবুদ্দিন আইবকের অধিকারে আসে।
  • অতঃপর বখতিয়ার নদিয়া ত্যাগ করে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসর হন। তিনি লক্ষণাবতী অধিকার করে সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এ লক্ষণাবতীই মুসলমান আমলে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়।
  • গৌড় জয়ের পর বখতিয়ার আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার বিস্তার করেন।
  • গৌড় বা লখনৌতি বিজয়ের দুই বছর পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে বের হন। এ তিব্বত অভিযানই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমর অভিযান।
  • কিন্তু তাঁর এ অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি দেবকোটে ফিরে আসেন। এখানে তিনি অসুস' হয়ে পড়লে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
  • অনুমান করা হয় আলী মর্দান নামে একজন আমীর তাকে হত্যা করেছিল।

মুহম্মদ শিরন খলজি

  • বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তাঁর সহযোদ্ধা তিনজন খলজী মালিকের নাম জানা যায়। এরা হচ্ছেন- মুহম্মদ শিরণ খলজি, আলী মর্দান খলজী এবং হুসামউদ্দীন ইওয়াজ খলজি।
  • আলী মর্দান খলজি বখতিয়ার খলজির হত্যাকারী হওয়ায় খলজি আমীর ও সৈন্যরা তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন মুহম্মদ শিরন খলজিকে।
  • খলজি আমীরদের সমর্থন পেয়ে তিনি আলী মর্দানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধে আলী মর্দান পরাজিত করে বন্দী করে রাখেন।
  • আলি মর্দান খিলজি কৌশলে দিল্লী পালিয়ে যান এবং দিল্লীর সুলতান কুবুতউদ্দিন আইবককে বাংলা আক্রমণ করতে প্ররোচিত করেন।
  • তার চক্রান্তে কুতুবউদ্দিন আইবেক অযোধ্যার গভর্নর কায়মাজ রুমিকে বাংলা আক্রমণ করতে বলেন।
  • মুহাম্মদ শিরান খলজী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিনাজপুর পালিয়ে যান। কিছুকাল পর তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।

হুসামউদ্দীন ইওয়াজ খলজি (১২০৮-১২১০: প্রথম দফা)

  • ১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতানের মনোনীত প্রার্থী হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ দেবকোটের শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • এই সময় আলী মার্দান দিল্লীতে কুতুবুদ্দিন আইবকের সাথে থেকে নানাভাবে সাহায্য করেন। বিশেষ করে কুতুবুদ্দিন আইবকের গজনী অভিযানে তিনি তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন।
  • ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে বাংলার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন।
  • আলী মার্দান এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলার অভিমুখে রওনা দেন। কিন্তু হুসাম উদ্দিন তাঁর সাথে যুদ্ধ করার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় তাঁর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন।

আলী মর্দান খলজী(১২১০-১২১২)

  • দিল্লীর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবকের সহযোগিতায় ১২১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • আলী মর্দান খলজি ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজের নাম নেন আলাউদ্দিন আলী মদার্ন খলজী।
  • ক্রমে ক্রমে তিনি অত্যাচারী সুলতান হয়ে উঠেন, ফলে বাংলার খলজি আমিররা যড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে ।

হুসামউদ্দীন ইওয়াজ খলজি (১২১২-১২২৭: দ্বিতীয় দফা)

  • আলী মদার্ন খলজীর মৃত্যুর পর ইওয়াজ খলজি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসেন। তিনি এ পর্যায়ে গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি নাম নিয়ে ১২১২ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন সুলতান হিসাবে বাংলা শাসন করেন।
  • শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী দেবকোট হতে গৌড় বা লখনৌতিতে স্থানান্তরিত করেন।
  • রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বসনকোট নাম স্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়।
  • তিনিই সর্বপ্রথম বাংলায় নৌবাহিনী গঠন করেন।
  • পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজারা, যেমন- কামরূপ, উড়িষ্যা, বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) এবং ত্রিহুতের রাজারা তাঁর নিকট কর পাঠাতে বাধ্য হন।
  • আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসিরের নিকট হতে সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি স্বীকৃতিপত্র লাভ করেছিলেন।
  • দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিশ গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজির ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। বিহারের তেলিয়াগড়ে গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খিলজির নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনী দিল্লীর সেনাদের কাছে পরাজিত হয়। ফলে সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে তিনি ইলতুতমিশকে ৮০,০০,০০০ টাকা ও ৩৮টি যুদ্ধের হাতি প্রদান করেন এবং ইলতুতমিশের নামে মুদ্রা জারি করেন। ইলতুৎমিশ খুশি হয়ে মালিক আলাউদ্দীন জানিকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে এবং ইওজ খলজিকে বঙ্গের শাসক পদে বহাল রেখে দিল্লী-তে ফিরে যান। কিন্তু সুলতান দিল্লী-তে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
  • ইলতুৎমিশ যখন অযোধ্যার বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত তখন ইওজ খলজি পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করেন। রাজধানী লক্ষনৌতিতে ইওজ খলজির অনুপস্থিতিতে ইলতুৎমিশ পুত্র নাসিরউদ্দীন মাহমুদ বঙ্গের রাজধানী লখনৌতি আক্রমণ করেন। এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইওজ খলজি অতি অল্প সংখ্যক সৈন্য সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন এবং যুদ্ধে ইওজ খলজি পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।

নাসিরউদ্দীন মাহমুদ (১২২৭-১২২৯ খ্রি.)

  • ইওজ খলজির পরাজয় ও পতনের পর দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরউদ্দীন মাহমুদ বঙ্গদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন এবং বঙ্গদেশ পুরোপুরিভাবে দিল্লীর সুলতানের অধিকারে আসে।
  • তিনি সুলতান ইলিতুতমিশের কাছ থেকে মালিক উশ-শার্ক ("পূর্বাঞ্চলের সম্রাট") উপাধি প্রাপ্ত হন।
  • ১২২৮ সালে, নাসিরুদ্দিন কামরূপের এক রাজা রাজা পৃথুকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিলেন।
  • ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দীন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন।

দৌলত শাহ বিন মউদুদ (১২২৯-১২৩০)

  • নাসিরুদ্দীন মাহমুদ এর মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
  • তিনি ৬২৭ হিজরি (১২৩০ খ্রি.) তারিখ সম্বলিত একটি মুদ্রা চালু করেন। এ মুদ্রায় তিনি নিজেকে সুলতান বলে চিহ্নিত করে পারসিক কায়দায় শাহ-ইন-শাহ উপাধি ধারণ করেন এবং দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশকে সুলতান-ই-আজম রূপে উল্লেখ করেন।
  • ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খলজী নামে অপর এক খলজী অভিজাত অচিরেই তাঁকে বিতাড়ন করেন।

ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খলজী(১২৩০-১২৩১ খ্রি.)

  • মালিক ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খলজী দৌলত শাহকে পরাভূত ও হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন (১২৩০ খ্রি.)।
  • দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে বলকা খলজীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বলকা খলজী বন্দি ও নিহত হন (১২৩১ খ্রি.)।

আলাউদ্দিন জানি(১২৩১-১২৩২ খ্রি.)

  • মালিক বলখা খিলজিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পরে সুলতান ইলতুতমিশ আলাউদ্দিনকে বাংলার শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন।
  • আলাউদ্দিন জানি ১২২৭ সালে গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ শাহের বিদ্রোহ দমন করতে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে সহায়তা করেছিলেন।
  • আলাউদ্দিন জানি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাকে সরিয়ে সাইফুদ্দিন আইবেককে বসানো হয়।

মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক(১২৩২-১২৩৬ খ্রি.)

  • মালিক সাইফুদ্দীন আইবেক দিল্লি সালতানাতের সময়ে ১২৩২ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত মামলুক রাজবংশের অধীনে বাংলার (লখনৌতি) গভর্নর ছিলেন।
  • তাকে আমির আল-মজলিস বা আমিরুল মজলিস উপাধি দেওয়া হয়।
  • তাঁর সময় দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিশের মৃত্যু হয়।
  • আউর খান আইবেক নামে এক বিদ্রোহী সভাসদ ১২৩৬ সালের এপ্রিল মাসে মালিক সাইফুদ্দীন আইবেককে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করে।

আউর খান আইবেক(১২৩৬ খ্রি.)

  • ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর আউর খান আইবেক নামে এক বিদ্রোহী সভাসদ ১২৩৬ সালের এপ্রিল মাসে মালিক সাইফুদ্দীন আইবেককে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করে বাংলার ক্ষমতা দখল করে।
  • অল্পকাল পরেই বিহারের শাসনকর্তা তুঘরল তুঘান খানের হাতে আউর খান আইবেক পরাজিত এবং নিহত হন।

তুগরল তুগান খান(১২৩৬-১২৪৫ খ্রি.)

  • প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের ক্রীতদাস ছিলেন।
  • সর্বপ্রথম সুলতান তাকে বদায়ুনের শাসনভার দেন।
  • পরবর্তীতে ১২৩২ সালে সুলতান তাকে বিহারের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন।
  • সুলতান ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর আউর খান আইবেক মালিক সাইফুদ্দীন আইবেককে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করে বাংলার ক্ষমতা দখল করলে ক্ষুব্দ তুগরল তুগান খান লখনৌতিতে আক্রমণ করেন এবং আউর খান আইবেককে পরাজিত ও নিহত করেন।
  • পরবর্তীতে দিল্লির তৎকালীন শাসক সুলতানা রাজিয়া তুগরল তুগান খানকে একই সাথে বাংলা ও বিহারের গভর্নর হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
  • তাঁর সময় বাংলা প্রদেশ ওড়িয়া সৈন্যবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়।
  • এই সময় অওধের শাসক মালিক তামার খান তাঁকে সাহায্য করেন।
  • পরবর্তীকালে অযোধ্যার শাসক মালিক নিজেই লখনৌতির শাসনভার হস্তগত করার জন্য তুগরল তুগান খানকে পরাজিত করেন।
  • ঐতিহাসিক মিনহাজের মধ্যস্থতায় সমঝোতা চুক্তি অনুসারে তামার খান, তুগান খানের কাছ থেকে লখনৌতি ও বিহারের শাসনভার অধিকার করেন।

তামার খান(১২৪৫-১২৪৭ খ্রি.)

  • তুগরল তুগান খানকে সিংহাসনচ্যুত করে বাংলার সিংহাসনে বসেন অওধের শাসক মালিক তামার খান।
  • ১২৪৭ সালে তামার খান জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

জালালউদ্দিন মাসুদ জানি(১২৪৭-১২৫১ খ্রি.)

  • ১২৪৭ সালে বিদ্রোহী তুঘলক তামর খানের মৃত্যুর পর মাসুদ জানি বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন।
  • তিনি প্রদেশের পুরাতন রাজধানী লখনৌতিতে একটি ওড়িয়া গ্যারিসনকে পরাজিত করার পর মালিক আল-মুলুক উশ-শার্ক (পূর্বের রাজাদের রাজা) উপাধি গ্রহণ করেন।
  • মাসুদ জানি চার বছর ধরে পূর্ব গঙ্গার সম্রাট নরসিংহ দেবের প্রতিনিধিত্বকারী বাহিনীকে পরাজিত অসফল হন।
  • তিনি ১২৫১ সাল পর্যন্ত বাংলার দায়িত্বে ছিলেন।

মালিক ইখতিয়ারউদ্দিন ইয়ুজবাক(১২৫১-১২৫৭ খ্রি.)

  • মাসুদ জানি চার বছর ধরে পূর্ব গঙ্গার সম্রাট নরসিংহ দেবের প্রতিনিধিত্বকারী বাহিনীকে পরাজিত করতে না পারার পর ইউজবাক বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন।
  • ১২৫৪ সালে তিনি উত্তর-পূর্ব বাংলার আজমারদান রাজ (বর্তমান আজমিরিগঞ্জ) আক্রমণ করেন এবং স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
  • ১২৫৫ সালে ইয়ুজবাক সম্রাট নরসিংহের বাহিনীকে প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
  • মান্দারান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ দখলের পরে নিজেকে দিল্লি সুলতানি থেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।
  • তিনি নিজেকে সুলতান মুগিথউদ্দিন আবুল মুজাফফর ইয়ুজবাক হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা তৈরি করেন।
  • ১২৫৬ সালের মধ্যে তিনি দিল্লির শাসন থেকে বিহার এবং আঊধকে দখল করেছিলেন।
  • ১২৫৭ সালে ইউজবাক কামরূপ অঞ্চল এবং কোচ হাজো আক্রমণ করলে পরাজিত ও নিহত হন।

ইজ্জাউদ্দিন বলবন ইয়ুজবাকি(১২৫৭-১২৫৯ খ্রি.)

  • মালিক ইখতিয়ারউদ্দিন ইয়ুজবাকের মৃত্যুর পর ইজ্জাউদ্দিন বলবন ইয়ুজবাকি দিল্লি সালতানাতের জন্য বাংলার গভর্নর হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন।
  • পরবর্তী দুই বছর লখনৌতি শাসন করেন মালিক উজ্জউদ্দিন ইউজবক।

তাতার খান (১২৫৯-১২৬৮ খ্রি.)

  • ইজ্জাউদ্দিন বলবন ইয়ুজবাকিকে সিংহাসনচ্যুত করে বাংলার শাসনকর্তা হন তাতার খান।
  • তিনি দিল্লীর প্রতি আনুগত্যী প্রকাশ করলেও কয়েক বছরের মধ্যে দিল্লীর সাথে বাংলার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

শের খান(১২৬৮-১২৭২ খ্রি.)

  • তাতার খানের মৃত্যুর পর বাংলার ক্ষমতায় বসেছিলেন শের খান।

আমিন খান আইতগিন(১২৭২ খ্রি.)

  • শের খানের মৃত্যুর পর দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন আমিন খান আইতগিনকে বাংলার শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন।
  • আমিন খান আইতগিন দুর্বল শাসক হওয়ায় গিয়াসউদ্দিন বলবন তুঘরিল খানকে সহকারী শাসক হিসাবে নিয়োগ করেন।
  • অল্প সময়ের মধ্যে তুঘরিল খান আমিন খান আইতগিনকে সিংহাসনচ্যুত করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।

তুঘরিল খান(১২৭২-১২৮১ খ্রি.)

  • তুঘরিল ছিলেন মামলুক তুর্কীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
  • উত্তর এবং পশ্চিম বাংলা ছাড়াও ঢাকা এবং ফরিদপুরের বেশ কিছু অঞ্চল তিনি অধিকারে আনেন।
  • সোনারগাঁওয়ের নিকট তিনি নারকিল- নামে এক দুর্গ তৈরিা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গটি তুঘরিলের কিল- নামে পরিচিত ছিল।
  • তুঘরিল ‘মুঘিসউদ্দিন’ উপাধি নিয়ো স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
  • ফলে দিল্লীর সুলতান বলবন প্রচণ্ড আক্রমণ হানেন তুঘরিলের উপর। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দেী বলবনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন তুঘরিল।

বুঘরা খান(১২৮১-১২৯১ খ্রি.)

  • বলবন তাঁর ছেলে বুঘরা খানকে বাংলার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করেন।
  • ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে বলবনের মৃত্যুর পর বুঘরা খান ‘নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ’ নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন।
  • এ সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন বুঘরা খানের ছেলে কায়কোবাদ।
  • কায়কোবাদের মৃত্যু সংবাদে বুঘরা খানের মন ভেঙ্গে যায়। তিনি তাঁর অন্য পুত্র রুকনউদ্দিন কায়কাউসকে বাংলার সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরে যান।

কায়কাউস (১২৯১-১৩০০ খ্রিঃ)

  • কায়কাউস তাঁর সাম্রাজ্যকে দুটি অংশে ভাগ করেন - বিহার প্রদেশ এবং লক্ষনৌতি প্রদেশ।
  • ইখতিয়ারউদ্দিন ফিরোজ ইতিগিনকে বিহার প্রদেশের শাসক নিযুক্ত করেন এবং শাহাবুদ্দিন জাফর খান বাহরাম ইতিগিন নিযুক্ত হন লখনৌতির শাসক।
  • কায়কাউস ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।

শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহ

  • কায়কাউসের কোনো ছেলে না থাকায় পরবর্তী শাসনকর্তা হন মালিক ফিরুজ ইতগীন।
  • তিনি সুলতান হিসেবে নতুন নাম ধারণ করেন ‘সুলতান শামসুদ্দিন ফিরুজ শাহ’।

গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ

  • ফিরুজ শাহের মৃত্যু হলে পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।
  • পিতার জীবদ্দশায় তিনি সাতগাঁওয়ের শাসক ছিলেন।
  • ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের হাতে তিনি পরাজিত ও বন্দী হন।
  • গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লীর সিংহাসনে বসেন এবং বাহাদুর শাহকে মুক্তি দিয়ে সোনারগাঁওয়ে বাহরাম খানের সাথে যুগ্মভাবে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
  • ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর বিদ্রোহ করলে তিনি বাহরাম খানের হাতে নিহত হন।

বাহরাম খান

  • গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে বাংলায় দিল্লীর শাসন শুরু করেন এবং বাংলাকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করেন-
    • লক্ষনৌতি - শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের ছোট ভাই নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম
    • সাতগাঁও ও সোনারগাঁও - শাসনকর্তা বাহরাম খান।
  • গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লীর সিংহাসনে বসেন এবং বাহাদুর শাহকে মুক্তি দিয়ে সোনারগাঁওয়ে বাহরাম খানের সাথে যুগ্মভাবে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
  • ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর বিদ্রোহ করলে বাহরাম খান তাঁকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
  • ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়।
  • বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর বর্মরক্ষক ‘ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী, ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের।